বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র, দুটি নক্ষত্র বাংলার রেনেসাঁসের দুই যুগন্ধর পুরুষ৷ ‘বিদ্যাসাগর’ আসলে সংস্কৃত বিদ্যাবত্তার এক শীর্ষ উপাধি এবং অনেকেই অবশ্য তার অধিকারী হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন৷ কিন্তু বিদ্যাসাগর শব্দটি উচ্চারণ করলে শুধু বাংলা কেন, সারা ভারতে যে একজনকেই বোঝায়, তাঁর নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর৷ আর বাংলায় যে বঙ্কিম নামটি বহুল প্রচলিত, তার মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র উল্লেখ করলে যে ব্যক্তির পরিচয়টি ভেসে ওঠে, তিনি সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ এই দুই যুগপুরুষই বাংলাভাষা নির্মাণ ও সাহিত্যসৃষ্টি তথা দেশহিতৈষায় অতুল কীর্তির স্বাক্ষর রেখেছেন৷ তবে তাঁদের কর্ম এষণায় একটি মূল পার্থক্য ছিল— বিদ্যাসাগরের প্রধান অন্বেষা ছিল দেশহিত ও সেই উদ্দেশ্যেই তাঁর লেখকজীবন৷ বঙ্কিমচন্দ্রের কিন্তু মূল প্রেরণা ছিল সাহিত্যসৃষ্টি এবং সেই সূত্রেই আসে দেশবন্দনার মন্ত্র বন্দেমাতরম্৷ বাংলা সাহিত্যের এই দুই দিকপাল আদিপুরুষের বিচিত্র ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে সমৃদ্ধ সাহিত্যসম্ভারে৷
সেই সাহিত্য-বিচিত্রায় একদিকে আছে বঙ্কিমচন্দ্রের গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ, আর অন্যদিকে আছে বিদ্যাসাগরের ভাষা শিক্ষার পাঠপ্রকরণ, অনুবাদ সাহিত্য এবং প্রবন্ধ৷ পার্থক্যটা আছে সাহিত্যিকের প্রকাশ মাধ্যমে৷ যেমন বিধবাবিবাহ বা বহুবিবাহ নিয়ে বিদ্যাসাগর আলোচনা করেছেন, প্রবন্ধে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে; এবং একই বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র ভাব প্রকাশ করেছেন উপন্যাসের মাধ্যমে৷ বিদ্যাসাগর কেন উপন্যাস লিখলেন না এবং বঙ্কিমচন্দ্র কেন সমাজ আন্দোলনের জন্যে প্রবন্ধ লিখলেন না, এই তর্ক বৃথা৷ কালিদাস পাণিণির মতো ব্যাকরণ না লিখলেও এবং পাণিণি কালিদাসের মতো মেঘদূত না সৃষ্টি করলেও, স্ব-স্ব ক্ষেত্রে উভয়েই মহান সৃষ্টির অধিকারী৷
বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে পৃথক পৃথকভাবে তথা উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক অবলম্বনে ইতিমধ্যে অনেক সুচিন্তিত আলোচনা হয়েছে৷ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এই দুই মনীষার অকৃপণ দানের প্রতি তাঁদের সার্থকতম উত্তরপুরুষ রবীন্দ্রনাথের বিশ্লেষণী শ্রদ্ধা নিবেদন৷ তবে এই দুই মনীষী স্ব স্ব ক্ষেত্রে দীপ্যমান হলেও তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্কে যে উষ্ণতার অভাব ছিল, সেটা খুব অস্পষ্ট নয়৷ বিদগ্ধ আলোচকরা দু’জনের সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে, ‘ভালোমন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে’, স্বীকার না করে বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম সম্পর্কের শীতলতাকে স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেছেন৷
বিদ্যাসাগরের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের একটি সূক্ষ্ণ বীতরাগ তাঁর দৃষ্টিকে যে বিভ্রান্ত করেছিল, সেকথা খুব স্পষ্ট৷ কেননা বঙ্কিমচন্দ্র বারবার বিদ্যাসাগরকে প্রকাশ্যে হেয় করার চেষ্টা করেছেন৷ অনেক পরিণত বয়সে বঙ্কিমচন্দ্রের বোধোদয় হয় যে, তিনি ঠিক করেননি৷ তাই পরিণত বয়সে বঙ্কিম তাঁর গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণে বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে কটু মন্তব্য প্রত্যাহার করেন৷ কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে৷ কেননা তার ফলে শেষ আঠেরো বছর বিদ্যাসাগরের সাহিত্যসৃষ্টি রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ সেটি বাংলাসাহিত্যের এক মহতি ক্ষতি বলে মনে হয়৷ সেইজন্যেই এই প্রবন্ধের অবতারণা৷
বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম থেকেই বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে বিদ্যাসাগরকে ‘Primer Writer’ বলে হেয় করার চেষ্টা করেছেন৷ যে বিদ্যাসাগরকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যিক গদ্যের জনক বলে অভিহিত করেছেন, তাঁর রচনাকে ‘বিদ্যাসাগরী গদ্য’ বলে হীনচোখে দেখা একমাত্র বিদ্বিষ্ট মনোভাবের পক্ষেই সম্ভব৷ বঙ্কিমচন্দ্রের সেই বিদ্যাসাগর বিদ্বেষের মূলে একটি প্রত্যক্ষ কারণও আছে বলে জানা যায়৷ তবে আমাদের বিদগ্ধ আলোচকরা সেটিকে ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টায় সত্যের অপলাপ করেছেন৷ সত্য স্বপ্রকাশ, তাকে যতই ঘোমটার আড়াল দেওয়ার চেষ্টা হোক না কেন, তা কখনও চাপা থাকে না৷
আমাদের মহাকাব্যের সবচেয়ে বড় গুণ, মহান চরিত্রগুলির মধ্যে অসাধারণ মহত্ত্বের সঙ্গে প্রচুর স্খলন, পতন ও ত্রুটি আছে৷ এমনকী আমাদের দেবতারাও ত্রুটিমুক্ত নন৷পুরুষোত্তম রাম কিংবা মহোত্তম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ, অবতারবরিষ্ঠ হলেও তাঁদের মানবিক স্খলনের নিদর্শনের ফলে মহাকাব্য বা মহাকাব্যের চরিত্রগুলির মর্যাদা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় না৷ আধুনিক যুগেও দেখি মহৎ সাহিত্যের স্রষ্টা টলস্টয়, শেক্সপিয়রকে কোনও মূল্যই দিতে চাননি৷ আবার সমসাময়িক মহাপ্রতিভা এইচ জি ওয়েলস ও বার্নার্ড শ’য়ের মধ্যে যথেষ্ট বিপ্রতীপ ভাব ছিল এবং একে অন্যকে সহ্য করতে পারতেন না৷ তার মূলে ছিল ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব ও তজ্জনিত বুদ্ধির বিভ্রান্তি৷ যেটি বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনভোর আচ্ছন্ন দৃষ্টির পরিচায়ক৷
আসলে বঙ্কিমচন্দ্রের ছিল দ্বৈতসত্তা— তার একদিকে ছিল ঔপন্যাসিক বঙ্কিমের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণজাত জীবনসত্যের প্রতিফলন; আর অন্যদিকে নীতিবাগীশ বঙ্কিমের জীবনকে অস্বীকার করার প্রবণতা৷ জীবন যেরকম, তার কথা লিখতে লিখতে হঠাৎ নীতিবাগীশের আক্রমণে বঙ্কিমের একাধিক উপন্যাসে কাহিনির পরিণতি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হঠাৎ যবনিকাপাত ঘটে৷
বাংলাভাষা, বিশেষ করে সাহিত্যের সেই আদি যুগে, স্বভাবতই ভাষা নির্মাণে বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্রকে শব্দচয়নে প্রভূত পরিমাণে সংস্কৃত তৎসম শব্দের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল৷ আমরা বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ ও দ্বিতীয়ভাগে শব্দ ও গদ্যের পরিচয় এবং রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠের পদ্য পাঠ শুরু করে যখন কথামালা শেষ করেছি, তারপরে বাংলা পাঠে আর স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব হয়নি৷ তবে পরবর্তীতে বিদ্যাসাগরের লেখা বেতালের গল্প, শকুন্তলা বা সীতার বনবাস সহজভাবেই পড়েছি৷ কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র পড়েছি, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য সম্পাদিত কিশোর সংস্করণে৷ পরে মাধ্যমিকে বাংলা পাঠ্যে, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সাগরসঙ্গমে নবকুমার’ বা ‘অপুর পাঠশালা’য় বিদ্যাসাগরের রচনার পরিচয় পেয়ে, গদ্যের লালিত্য ও ঝঙ্কারে বিস্মিত হতে হয়৷
পরে বয়স বাড়লে, বসুমতী সংস্করণে বঙ্কিমচন্দ্রের মূল উপন্যাস এবং বিদ্যাসাগরের ভ্রান্তিবিলাস, শকুন্তলা, সীতার বনবাস পড়ে খুবই মুগ্ধ হয়েছি৷ তারপরে বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের লেখায় তাঁদের সৃষ্টির মহত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা পরিপুষ্ট হয়৷ কিন্তু প্রথম হোঁচট খেতে হয়, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মসার্ধশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত, সাক্ষরতা প্রকাশনের বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহের ভূমিকা পড়ে৷ সেখানে ‘সংস্কৃতানুরাগিণী’ বিদ্যাসাগরী বাংলা সম্বন্ধে বঙ্কিমের বক্রোক্তি এবং He is only a primer writer বলে তাকে হেয় করার কথা পড়ে বিস্মিত হয়েছি৷ স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জীবনস্মৃতিতে উল্লেখ করেছেন, “বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম প্রথম শ্রদ্ধার ভাব ছিল না৷ তিনি বলতেন, He is only a primer writer. তিনি খানকতক পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন বই তো নয়৷ তাঁর বহরমপুরের বৈঠকখানায় দীনবন্ধু মিত্র, লালবিহারী দে, গুরুদাস প্রমুখের উপস্থিতিতে বঙ্কিম এই মন্তব্য করেছিলেন৷’’ ঈশ্বরচন্দ্রের ‘সীতার বনবাস’ সম্পর্কে বঙ্কিম বইটির কোনও গুণ লক্ষ না করে বলেছিলেন, এটি একটি Tear Jerker. বিষবৃক্ষ উপন্যাসে বঙ্কিম সূর্যমুখীর উক্তিতে বলেছেন, ‘যে বিদ্যাসাগর বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয় সে যদি পণ্ডিত তবে মূর্খ কে৷’ এটি এক বেদনাবিহ্বল স্ত্রীর বক্তব্য হতেই পারে, কিন্তু তার কোনও প্রত্যুত্তরের অবকাশ না থাকায় এটিকে লেখকের (বঙ্কিমচন্দ্রের)একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শ্লেষ বলেই প্রতীয়মান হয়৷ আসলে বঙ্কিমচন্দ্রের ছিল দ্বৈতসত্তা— তার একদিকে ছিল ঔপন্যাসিক বঙ্কিমের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণজাত জীবনসত্যের প্রতিফলন; আর অন্যদিকে নীতিবাগীশ বঙ্কিমের জীবনকে অস্বীকার করার প্রবণতা৷ জীবন যেরকম, তার কথা লিখতে লিখতে হঠাৎ নীতিবাগীশের আক্রমণে বঙ্কিমের একাধিক উপন্যাসে কাহিনির পরিণতি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হঠাৎ যবনিকাপাত ঘটে৷
বঙ্কিমচন্দ্র যে বিদ্যাসাগরের রচনার বিষয় শুধু নয়, তাঁর রচনারীতির সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না সে বিষয়ে তাঁর অনেক স্পষ্ট বক্তব্য আছে৷ যেমন তিনি বাংলা রচনায় বিদ্যাসাগর অপেক্ষা ভূদেব মুখোপাধ্যায় বা কবি ঈশ্বর গুপ্তকে প্রাধান্য দিয়েছেন৷ তাছাড়া, ‘বাংলা ভাষা লিখিবার ভাষা’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র, “সংস্কৃতবাদী সম্প্রদায়ের মুখপাত্রস্বরূপ আমরা রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয়কে গ্রহণ করিতেছি’’ বললেও তাঁর আসল লক্ষ্য যে বিদ্যাসাগর তা সুস্পষ্ট৷ প্রথমত টেকচাঁদি ভাষা’র গুণকীর্তন করে, টেকচাঁদের ভাষায় রঙ্গরস আছে এবং ভাষার জন্য তার প্রয়োজনের উল্লেখ করে বঙ্কিমচন্দ্র আক্রমণাত্মকভাবে বললেন, ‘কেবল বিদ্যাসাগরী রচনা শ্রবণে কর্ণের যে একরূপ ভাব জন্মে, তাহার পরিবর্তন করণার্থ মধ্যে মধ্যে অপরবিধ রচনা শ্রবণ করা পাঠকদিগের আবশ্যক৷’ আসলে বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের বীতরাগ তাঁকে এমন অন্ধ করেছিল যে, যাকে দেখতে নারি তার চরণ বাঁকা বলে, বঙ্কিমচন্দ্র আজীবন বিদ্যাসাগরের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিলেন৷
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, যে বিদ্যাসাগরকে বাংলা সাহিত্যের গদ্যের জনক বলে অভিহিত করেছেন তাঁর সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনব্যাপী এহেন দৃষ্টিহীনতায়, হতবুদ্ধি আমি যখন অনুসন্ধিৎসু, তখনই চোখে পড়লো ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্র বিশেষ সংখ্যায় (২০১৬-১৭), বঙ্কিম গবেষক অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের লেখা ‘অনোন্য দর্শন: বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র৷’ বঙ্কিমচন্দ্রকৃত ভবভূতির উত্তররামচরিত নাটকের আলোচনায় বঙ্কিম বিদ্যাসাগরের প্রতি অতিশয় আক্রমণাত্মক স্তবকদুটি পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় বর্জন করেছিলেন৷ গবেষক অমিত্রসূদন, পাঠকের জ্ঞাতার্থে সেটি তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করায়, অধ্যাপক ভবতোষ দত্তের বিরাগভাজন হয়েছিলেন৷
অমিত্রসূদন বলেছেন, শৈশবে বা কলেজের পরীক্ষায় পরীক্ষক বিদ্যাসাগরের হাতে কম নম্বর পেয়েছিলেন বলে বঙ্কিমচন্দ্র সেই রাগ মনের মধ্যে পুষে রেখে সারাজীবন বিদ্যাসাগর-বিরোধিতা করেছিলেন—এমন ক্ষুদ্রচেতা সামান্য মানুষ বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন না৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট বঙ্কিমচন্দ্র এবং যদুনাথ বসু— দু’জনেই বিএ পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন এবং পরে গ্রেস নম্বর পাওয়ার ফলে পাশ করেন৷ বাংলায় কম নম্বর পাওয়া, তাঁর (বঙ্কিমচন্দ্রের) আত্মাভিমানকে আহত করে৷ কৈশোরে পোষিত সেই আহত আত্মাভিমানই বঙ্কিমকে পরে বিদ্যাসাগর-বিরোধী করে তোলে৷
আত্মাভিমানী বঙ্কিমচন্দ্র তাই বাংলায় কম নম্বর পাওয়ায় তাঁর সমস্ত ক্ষোভ অযৌক্তিকভাবে পরীক্ষকের উপর এবং পরে পরীক্ষকের পরিচয় জানতে পেরে তাঁর(বিদ্যাসাগর) প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন৷ সেই উঠতি বয়সে, অনুকরণসর্বস্ব শিক্ষার্থীর ভাষা কখনওই খুব পরিণত হতে পারে না এবং বিচক্ষণ শিক্ষক ও ভাষানির্মাতা বিদ্যাসাগরের মার্জিত ভাষারীতি সম্বন্ধে নিজস্ব ধারণা ছিল৷ সুতরাং তিনি স্বীয় মানদণ্ড অনুযায়ী ছাত্রের উত্তরপত্র পরীক্ষা করেছিলেন৷ বঙ্কিমচন্দ্রের সেই আহত অভিমানই পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগরের ভাষানির্মাণ ও সাহিত্যসৃষ্টির যথাযথ মূল্যায়নে বাধা দেয়৷
বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বলেন, “…তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও বিরামহীন প্রচেষ্টা বাংলা গদ্যসাহিত্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনল৷ বাংলা ভাষার মাধ্যমে সহজেই আধুনিক চিন্তা ও অনুভূতিকে প্রকাশ করা যেতে লাগল৷এই অর্থে বিদ্যাসাগর সত্যিই বাংলাভাষার জনক৷ তিনি যে ভিত স্থাপন করে গিয়েছিলেন, তার উপর দাঁড়িয়েই বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে বিশ্বস্তরে সাহিত্য-ভাষা সৃষ্টি করতে সমর্থন হয়েছিলেন৷৷”
‘বিদ্যাসাগর চরিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বললেন, “তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা৷… বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন৷… তিনিই প্রথম বাংলা গদ্যের কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন৷… বাংলাভাষাকে পূর্বপ্রচলিত অনাবশ্যক সমাসাড়ম্বর ভার হইতে মুক্ত করিয়া তাহার পদগুলির মধ্যে অংশ যোজনার স্থাপন করিয়া বিদ্যাসাগর যে বাংলা গদ্যকে কেবলমাত্র সর্বপ্রকার ব্যবহারযোগ্য করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন তাহা নহে, তিনি তাহাকে শোভন করিবার জন্যই সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন৷” (বিদ্যাসাগর স্মৃতি)৷
অন্যত্র কবি বলেছেন, “… বাংলাভাষার নির্মাণকার্যে সংস্কৃত ভাষার ভাণ্ডার থেকে তিনি যথোচিত উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন৷ তাই তাঁর আহরিত সংস্কৃত শব্দের সবগুলিই বাংলা ভাষা সহজে গ্রহণ করেছে৷ আজ পর্যন্ত তার কোনওটিই অপ্রচলিত হয়ে যায়নি…৷ বিদ্যাসাগরের দান বাংলা ভাষার প্রাণপদার্থের সঙ্গে মিলে গেছে, কিছুই ব্যর্থ হয়নি৷ “যে গদ্যভাষা রীতির” তিনি প্রবর্তন করেছেন তার ছাঁচটি বাংলাভাষায় সাহিত্যরচনা কার্যের ভূমিকা নির্মাণ করে দিয়েছে৷… বঙ্গসাহিত্যে আমার কৃতিত্ব দেশের লোকে যদি স্বীকার করে থাকেন, তবে আমি যেন স্বীকার করি একদা তার দ্বার উদঘাটন করেছেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর৷”
কিন্তু সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র সেকথা স্বীকার না করে অন্য ঈশ্বর, বা কবি ঈশ্বর গুপ্তের গুণপনায় মুখর হয়েছেন৷ ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সেই ঈশ্বর গুপ্ত প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, “বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে, ঈশ্বর গুপ্ত যখন সাহিত্যগুরু ছিলেন বঙ্কিম তখন তাঁহার শিষ্যশ্রেণির মধ্যে গণ্য ছিলেন৷ সে সময়কার সাহিত্য… ঠিক সুরুচিশিক্ষার উপযোগী ছিল না৷…”
আবার এই ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথ লিখছেন— “আমাদের মধ্যে যাঁহারা সাহিত্যব্যবসায়ী তাঁহারা বঙ্কিমের কাছে যে কী চিরঋণে আবদ্ধ তাহা যেন কোনোকালে বিস্মৃত না হন৷ একদিন আমাদের বঙ্গভাষা কেবল একতারা যন্ত্রের মতো এক তারে বাঁধা ছিল, কেবল সহজ সুরে ধর্মসঙ্কীর্তন করিবার ভাষা ছিল৷ বঙ্কিম স্বহস্তে তাহাতে একটি একটি করিয়া তার চড়াইয়া আজ তাহাকে বীণা যন্ত্রে পরিণত করিয়া তুলিয়াছেন৷”
বঙ্কিম প্রসঙ্গে কবি আরও বলেন… ‘রামমোহন বঙ্গসাহিত্যকে গ্রানিট স্তরের উপর স্থাপন করিয়া নিমজ্জনদশা হইতে উন্নত করিয়া তুলিয়াছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র তাহারই উপর প্রতিভার প্রবাহ ঢালিয়া স্তরবদ্ধ পলিমৃত্তিকা ক্ষেপণ করিযা গিয়াছেন৷ আজ বাংলাভাষা কেবল দৃঢ় বাসযোগ্য নহে, উর্বরা শস্যশ্যামল হইয়া উঠিয়াছে৷ … রচনা ও সমালোচনা এই উভয় কার্যের ভার বঙ্কিম একাকী গ্রহণ করাতেই বঙ্গসাহিত্য এত সত্বর এত দ্রুত পরিণতি লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছিল৷… নির্মল শুভ্র সংযত হাস্য বঙ্কিমই সর্বপ্রথমে বঙ্গসাহিত্যে আনয়ন করেন৷’
আসলে বিদ্যাসাগরকে Pime-Writer হিসেবে হেয় করার চেষ্টায় বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্বিষ্ট হৃদয়ে বিদ্যাসাগরের কর্মকৃতির যথাযথ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন৷ বিদ্যাসাগরের সমস্ত সাহিত্যকর্মের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের মতো সাহিত্যসৃষ্টি নয়৷ তাঁর রচনা সব সময়ই আবর্তিত হয়েছে তাঁর উপলবহুল কর্মোদ্যোগের সহযোগীরূপে৷
বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগে, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’কে ‘আদি কবিতা’ বলে উল্লেখ করে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবন স্মৃতিতে’ তাঁর সেই বালক বয়সে বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষের জন্যে অধীর উৎকণ্ঠার কথাও বলেছেন৷ তার ফলে কিশোরকবির মনে এই দুই প্রতিভার বিস্ময় খুব স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে৷
কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক বঙ্কিমচন্দ্র কিন্তু তাঁর পূর্বসুরী বিদ্যাসাগরের সাহিত্যপ্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন করতে অপারগ হয়েছেন৷ সেটা অবশ্যই তাঁর প্রতিভার অক্ষমতা নয়, বিদ্বেষপ্রসূত বিভ্রান্তির ফল৷ প্রথমে আমরা বঙ্কিমের বিদ্যাসাগরী ভাষা সম্বন্ধে অভিযোগের প্রসঙ্গ আলোচনার আগে তাঁদের দু’জনের দু’টি পরিচিত উদ্ধৃতির উল্লেখ করব৷ প্রথমটি, বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’ থেকে—“এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি৷ এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমান জলধরমণ্ডলী যোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত৷ অধিত্যকাপ্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিভিন্ন বনপাদসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী তরঙ্গবিস্তার করিয়া প্রবলবেগে গমন করিতেছে৷” পথের পাঁচালীর অপু পাঠশালায় এই বাক্যঝঙ্কার শুনে মোহিত হয়েছিল৷
অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ থেকে একটি উদ্ধৃতি — (নবকুমার) “গাত্রোত্থান করিয়া সমুদ্রের দিকে ফিরিলেন, ফিরিবামাত্র দেখিলেন, অপূর্ব মূর্তি৷ সেই গম্ভীরনাদী বারিধিতীরে সৈকতভূমে অস্পষ্ট সন্ধ্যালোকে দাঁড়াইয়া অপূর্ব রমণীমূর্ত্তি৷ কেশভার আবেণীসম্বন্ধ, সংসর্পিত, রাশীকৃত আগুল্ফলম্বিত কেশভার৷ তদগ্রে দেহরত্ন; যেন চিত্রপটের উপর চিত্র দেখা যাইতেছে৷ অলকাবলীর প্রাচুর্য্যে মুখমণ্ডল সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ হইতেছিল না৷ – তথাপি মেঘ বিচ্ছেদ নিঃসৃত চন্দ্ররশ্মির ন্যায় প্রতীত হইতেছিল৷”
দু’টি গদ্য রচনাই আপন মহিমায় স্বচ্ছন্দ ছন্দে প্রবাহিত৷ একবার নাকি বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমের এক-একটি বই থেকে সমান পরিমাণ মুদ্রিত অংশে, সংস্কৃত শব্দ গণনায় দেখা যায় বিদ্যাসাগরের আছে ৫৫টি সংস্কৃত শব্দ এবং বঙ্কিমের আছে ৬৫টি৷ এই কথার উল্লেখ করে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন, “দেখিলাম যে বিদ্যাসাগর মহাশয় একটু বিচলিত হইয়াছেন৷ কথাটা চাপা দিবার জন্য আমি বলিলাম— চলিত ভাষায় বইলেখা কি আপনার মত নয়৷ তিনি বলিলেন, ভাষাটা মার্জিত হওয়া চাই৷” (বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, সাক্ষরতা প্রকাশন)৷ বঙ্কিমের ভাষায় ব্যবহৃত ‘শবপোড়া মড়াদাহ’ দলের সাধুচলিতের মিশ্রণ বোধহয় মার্জিত গদ্যের পক্ষপাতী বিদ্যাসাগরের পছন্দ ছিল না৷ বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমের এই সংস্কৃত শব্দবহুল রচনা পরে স্বাভাবিকভাবেই সরলতর বাংলায় প্রকাশিত৷ বিদ্যাসাগরের রচনায় তার প্রমাণ যদি থাকে ‘আত্মচরিতে’ তাহলে বঙ্কিমচন্দ্রের আছে ‘কমলাকান্তের দপ্তরে৷’
কিন্তু বিদ্যাসাগরের সহজতর বাংলাভাষা নির্মাণ সম্বন্ধে যে একটি সদা জাগ্রত উদ্যোগ ছিল, তার পরিচয় পাওয়া যায়, তাঁর মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত স্বহস্তে লিখিত শব্দসংগ্রহে, যা পরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক প্রকাশিত হয়৷ এই প্রসঙ্গে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বাংলা আকাদেমির গবেষক অমিতাভ মুখোপাধ্যায় বলেন, “এই সংগ্রহে শব্দসংখ্যা (সাত হাজারের মতো) হয়তো তেমন বেশি নয়, কিন্তু এটিই প্রথম বাংলা বানান অভিধান৷ কিংবা বিশেষত করে বলা যায়—বাছাই করা অর্ধতৎসম শব্দের বানান অভিধান৷… হ্রস্ব উচ্চারণই যে বাঙালির স্বাভাবিক প্রবণতা এবং মূর্ধন্য (ণ) বাঙালির উচ্চারণে আসে না—এই সত্যের প্রতি বিদ্যাসাগরের প্রত্যয় ধরা পড়ে সংকলনে… শব্দাবলির বানানে৷’’
আসলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কারের উদ্যোগের বহু আগে বিদ্যাসাগর বাংলা শব্দের সংগ্রহ ও বানান নিয়ে চর্চা করেছেন৷ বঙ্কিমের তীক্ষ্ণ আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে বিদ্যাসাগরের সাহিত্যসৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেলেও অসুস্থ শরীর সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর সহজতর বাংলাভাষা গঠনে অক্লান্তকর্মা ছিলেন৷ তাঁর মৃত্যুর পরে এই ‘শব্দমঞ্জরী’ আবিষ্কৃত হয় ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক প্রকাশিত হয়৷
আসলে বিদ্যাসাগরকে Pime-Writer হিসেবে হেয় করার চেষ্টায় বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্বিষ্ট হৃদয়ে বিদ্যাসাগরের কর্মকৃতির যথাযথ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন৷ বিদ্যাসাগরের সমস্ত সাহিত্যকর্মের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের মতো সাহিত্যসৃষ্টি নয়৷ তাঁর রচনা সব সময়ই আবর্তিত হয়েছে তাঁর উপলবহুল কর্মোদ্যোগের সহযোগীরূপে৷ সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষরূপেই তিনি শিক্ষার প্রয়োজনে বাংলাভাষার বিকাশে একদিকে ইংরেজি শিক্ষা, সংস্কৃতশিক্ষা ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার অনুধাবনে বাংলায় পাঠ্য রচনা করতে আরম্ভ করেন৷ কেননা উত্তম শিক্ষার জন্যে প্রয়োজন উত্তম পুস্তক ও নির্দিষ্ট শিক্ষাবিদ স্যার আশুতোষও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এমএ পরীক্ষা প্রবর্তনের আগে দীনেশচন্দ্র সেন সহ অনেককে ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে বই লেখায় ব্রতী করেন৷
বিদ্যাসাগর বাংলাভাষা শিক্ষার জন্য একেবারে অক্ষর পরিচয়ের আদিপর্বের সংস্কার থেকে ‘বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয ভাগ এবং কথামালা রচনা করেন, তা পরবর্তী একশো বছর অবধি বাংলা ভাষাভাষীকে অক্ষর পরিচয় করিয়েছে৷ এই তিনটি বই বাংলাভাষা শিক্ষার যে ভিত্তিভূমি তৈরি করে, তার ফলে বাংলা সাহিত্য অনায়াসগম্য হয়ে ওঠে৷সংস্কৃত শিক্ষার ভিত্তিভূমি তৈরির জন্যই বাংলায় সংস্কৃত ব্যাকরণ উপক্রমণিকা, সমগ্র ব্যাকরণ কৌমুদী ও প্রাথমিক ঋজুপাঠ (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়) রচনা করেন৷ বিদ্যাসাগরের পরে রবীন্দ্রনাথও Pimer রচনায় সহজপাঠ (প্রথম থেকে চতুর্থ) ছাড়াও শিশুপাঠ্য ও স্কুলপাঠ্য বই নিজে রচনা করেননি, বিশ্বভারতীতে অন্য অনেককে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছেন৷ রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রবিচিত্র’, ‘শিশু’, ‘নদী’ ‘ছড়ার ছবি’, ‘খাপ ছাড়া’ প্রভৃতি সবই শিশু ও কিশোরদের জন্য লিখিত৷
এক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান খুবই ক্ষীণ৷ কিন্তু তাতে যেমন কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না, তেমনি সুকুমার রায় কেন দুর্গেশনন্দিনী লেখেননি সেজন্য তাঁকে দোষারোপ করা বৃথা৷ তবে যতদিন বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে ততদিন বঙ্কিমচন্দ্র ও সুকুমার রায় অক্ষয় মহিমায় বেঁচে থাকবেন৷
পাঠ্যপুস্তক রচনার কথা বাদ দিলেও বিদ্যাসাগরের যে অনবদ্য অনুবাদ সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের সম্পদ সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না৷ ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ দিয়ে আরম্ভ করে, শকুন্তলা, সীতার বনবাস, বা শেক্সপিয়র অবলম্বনে ‘ভ্রান্তিবিলাস’ পড়ে কারোরই মনে হওয়ার কথা নয় যে, এগুলি অনুবাদমাত্র৷ বাংলায় অনুবাদ সাহিত্যের সফল পথপ্রদর্শক বিদ্যাসাগর, আক্ষরিক অনুবাদ না করে; বাংলায় সেটিকে নতুন করে সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন৷ তিনিই Translation-এর বদলে Transcreation-কে বাংলা ভাষায় প্রতিষ্ঠা করেছেন৷ তিনি মহাভারতেরও বাংলায় অনুবাদ আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু বঙ্কিমের অকারণ সমালোচনার আক্রমণে অগ্রসর হওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন৷ তাছাড়া বিদ্যাসাগর সম্পাদিত সংস্কৃত ও বাংলা গ্রন্থের সম্ভারও বিপুল৷
রসরচনাতেও বিদ্যাসাগর বঙ্কিমের পূর্বসূরী৷ তাঁর ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ প্রণীত, ‘অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩) ‘আবার অতি অল্প হইল’, ‘ব্রজবিলাস’, কস্যাচিৎ তত্ত্বানেবিষণ প্রণীত ‘বিধবাববিাহ ও যশোরের হিন্দু ধর্মরক্ষিণী সভা বিষয়িণী’, ‘রত্নপরীক্ষা’ প্রভৃতি খুবই আকর্ষণীয়৷ স্যাটায়ার ও light banter-এর মাধ্যমে বিদ্যাসাগরই প্রথম তির্যকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতিপাদনের সার্থক প্রয়াস করেন৷ এবং সেগুলি জনসমাদৃত হয় বলেই, ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত ‘ব্রজবিলাস’ সেই বছরই দ্বিতীয় সংস্করণের বিজ্ঞাপনে বিদ্যাসাগর লেখেন, ‘ব্রজবিলাস’ নিঃশেষিত হইয়াছে৷ কিন্তু গ্রাহকবর্গের আগ্রহনিবৃত্তি হয় না৷ এজন্য, অন্য অনেকের অনুরোধ—পরতন্ত্র হইয়া এই মহাকাব্য পুনরায় মুদ্রিত করা হইলো৷’ বিদ্যাসাগরের রচনাগুলির তুলনায় বঙ্কিমচন্দ্র ব্যতীত সমকালীন রসরচনাকারদের লেখালেখি স্থূল রসিকতাপূর্ণ ও ভেকের কলরব বলে মনে হয়৷
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম বাংলা সাহিত্য নির্মল হাস্যরসের সূচনা করেন৷ সেই ১৮৮৪ সালেই বঙ্কিমচন্দ্রের ‘মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত’ নামে স্যাটায়ার গ্রন্থ প্রকাশিত হয়৷ লেখকের ‘লোকরহস্য’ (১৮৭৪) দিয়ে লঘু কৌতুকের শুরু৷ তার পরে তাঁর স্যাটায়ার তথা রসরচনার উৎকর্ষ পরিণতিতে ‘কমলাকান্তের জবানবন্দী’ রচিত হয়, যা পরে ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ (১৮৮২) গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়৷ কমলাকান্তের দপ্তর প্রসঙ্গে অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত লেখেন, ‘কমলাকান্ত হাসির সঙ্গে করুণের, অদ্ভুতের সঙ্গে সত্যের, তরলতার সঙ্গে মর্মদাহিনী জ্বালার, নেশার সঙ্গে তত্ত্ববোধের, ভাবুকতার সঙ্গে বস্তুতন্ত্রতার, শ্লেষের সহিত উদারতার এক অদ্ভুত সমন্বয়৷’ আসলে বাংলা সাহিত্যে ভাঁড়ামি, স্থূল রসিকতা দিয়ে যার আরম্ভ, বিদ্যাসাগরের মার্জিত স্যাটায়ার যার উত্তরণ, মধুসূদনের কৌতুকনাট্যে যার নিদর্শন, বঙ্কিমের লোকরহস্যের কৌতুক থেকে কমলাকান্তের হিউমারে তার সফল পরিণতি- এই রচনাধারা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ৷
পাঠ্যরচনা, সম্পাদিত ধ্রূপদী সাহিত্য, অনুবাদে উৎকর্ষের তথা স্যাটায়ারসমৃদ্ধ বিদ্যাসাগরের সাহিত্যসৃষ্টি বঙ্কিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারলেও, সমাজ আন্দোলনের প্রয়োজনে বিদ্যাসাগরের গভীর মননশীল প্রবন্ধসাহিত্যকে মোটেই অস্বীকার করা যায় না৷ তাহলে তো বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় স্রষ্টা রামমোহনেরও কোনও প্রাসঙ্গিকতা থাকতে পারে না৷ সতীদাহ নিয়ে রামমোহন ও বিধবাবিবাহ নিয়ে বিদ্যাসাগরের আলোচনামূলক বিপুল প্রবন্ধরাশি, বাংলাভাষাকে গভীর গম্ভীর তত্ত্বানুলোচনার উপযুক্ত করে তুলেছিল৷ সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে বঙ্কিমচন্দ্রের তিন খণ্ড রচনাবলির মধ্যে মাত্র একখণ্ড জীবনান্বেষু চিন্তাসমৃদ্ধ বিচিত্র ভাবনার প্রকাশে সমৃদ্ধ৷ তেমনই বিদ্যাসাগরেরও তিন খণ্ড রচনাবলরি মধ্যে একটি খণ্ড সমাজ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তর্ক-বিতর্ক চিন্তাঋদ্ধ প্রবন্ধাবলিতে পূর্ণ৷ কিন্তু সেগুলি যে বঙ্কিম-আগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয় তার কারণ বঙ্কিমের দ্বৈত সত্তার রক্ষণশীল নীতিবাগীশ প্রকৃতি৷
বিদ্যাসাগর ছিলেন কর্মযোগী; প্রথম জীবনে শিক্ষা ও সংস্কার আন্দোলন দিয়ে শুরু করে পরে সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন৷ বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বহুবিবাহ তথা বাল্যবিবাহ রোধ ছিল বিদ্যাসাগরের মধ্যজীবনের সংঘাতময় অতি সক্রিয় জীবন৷ প্রথম জীবনে যেমন তিনি শিক্ষার প্রয়োজনে পাঠ্য রচনা তথা অনুবাদকর্মে ব্রতী হয়েছিলেন, তেমনই উত্তরভাগে স্ত্রীশিক্ষা, বিধবাবিবাহ ও বহুবিবাহ রোধের জন্য রক্ষণশীল বিরোধীদের সংস্কারবদ্ধ যুক্তিহীনতাকে নস্যাৎ করতে কলম ধরেন৷এখানেও তাঁর সঙ্গে রক্ষণশীল বঙ্কিমের বিরোধ স্পষ্ট ধরা পড়ে৷ হিন্দু সমাজের প্রচলিত যে স্বার্থসন্ধ বীভৎস নারকীয়তা ‘সতীদাহ’ নামে কুখ্যাত, যা রামমোহনের অক্লান্ত চেষ্টায় অবশেষে অবসিত হয়, সেই সজ্ঞান নারীহত্যা সম্বন্ধেও বঙ্কিমের গৌরবান্বিত উক্তি আছে৷ তিনি এক জায়গায় বলেছেন, ‘যে দেশের নারীরা হাস্যমুখে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় আরোহণ করেন তাদের সতীত্ব, জগতে তুলনারহিত৷’
তাই দেখা যায়, জীবনের রূপকার বঙ্কিম বারেবারেই হার মেনেছেন সনাতনধর্মী নীতিবাগীশ বঙ্কিমের কাছে৷ সনাতনী মোহে অভিভূত বঙ্কিম সতীদাহের অন্তরালে যে বেদনামথিত যন্ত্রণাকাতর কান্না আছে, তা অনুভব করতে বাধা পান৷ সতীদাহ যে ভারতীয় শাস্ত্রানুযায়ী প্রথা নয়, তার সমর্থন আছে মহাভারতে, যেখানে সত্যবতী ও কুন্তী সহমৃতা হননি৷ বিধবাববিাহ সম্বন্ধেও বঙ্কিমের উক্তি— আইন করে কোনও সামাজিক প্রথাকে রদ করা যায় না, তাও তাঁর চিন্তার বিভ্রান্তির পরিচয়বহ৷ তাঁর সামনেই যে রামমোহনের প্রচেষ্টায় আইন করে সতীদাহ প্রথা রদ হয়ে গেল, সে কথা তিনি খেয়াল করেননি৷
আসলে বঙ্কিমের মনে হয়নি যে, সমাজে প্রচলিত কোনও শাস্ত্রের দোহাই পাড়া কুসংস্কারকে সমূলে উৎপাটিত করতে শাস্ত্রের সাক্ষ্য গ্রহণ করে আইন করতে হয়; শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় ‘চাপরাশ সংগ্রহ করতে হয়’ লোকমান্যের জন্য৷ নাহলে সংস্কারকে অশাস্ত্রীয় বলে অপব্যাখ্যার দ্বারা জিইয়ে রাখার সমূহ সুবিধা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা ও আন্দোলনের অনলস সক্রিয়তায় বিধবাবিবাহকে গ্রহণীয় করতে বিদ্যাসাগর শুধু শাস্ত্রালোচনা করেই ক্ষান্ত হননি৷ নিদর্শনস্বরূপ নিজের ছেলের বিবাহ দিয়েছেন তো বটেই তাছাড়া একাধিক বিয়েতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছেন, এমনকী ঋণ করেও৷ স্বভাবতই তখন একটি রেওয়াজ দাঁড়িয়েছিল, বাল্যবিধবাকে বিদ্যাসাগরের বাড়ির বাইরে বসিয়ে রাখার, বিদ্যাসাগরের দয়ালাভের উদ্দেশ্যে৷ বিদ্যাসাগরও সেটিকে জীবনের একটি ব্রত রূপে গ্রহণ করেছিলেন৷
বিধবাবিবাহ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বঙ্কিমের জীবনাচারেও পার্থক্য খুব স্পষ্ট৷ বিদ্যাসাগর শুধু অপরের ছেলেদের সঙ্গে বিধবাবিবাহ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, নিজের ছেলেরও বিধবার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন৷ কিন্তু নিজেদের পরিবারে বঙ্কিমের আচরণ ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত৷বঙ্কিমচন্দ্রের দৌহিত্রের সঙ্গে স্যার আশুতোষের নাবালিকা কন্যা কমলার বিয়ে হয় এবং অচিরেই কমলা বিধবা হন৷ স্যার আশুতোষ যখন তাঁর বিধবা কন্যার পুনর্বিবাহের চেষ্টা করেন, তখন বঙ্কিমের পরিবার থেকে বাধা আসে, এমনকী তা আদালত অবধি গড়ায়৷
জীবনের রূপকার বঙ্কিম যেমন বাংলাসাহিত্যে উপন্যাসের স্রষ্টা, তেমনই নিঃসন্দেহে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী৷ অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের কথায়, বঙ্কিমই বাংলাসাহিত্যের “সর্বস্বীকৃত গুরু, যিনি বাংলাকে বিশ্বসাহিত্যের আঙিনায় নিয়ে এসেছেন৷” সমসাময়িক সময়ে যখন ‘বিধবাবিবাহ’, ‘বহুবিবাহ’ নিয়ে সমাজ উত্তাল, তখন কথাকার বঙ্কিম যে অসীম সাহসে বিবাহ-বহির্ভূত প্রেমকে তাঁর একাধিক উপন্যাসে স্থান দিয়েছেন, সে বিষয়ে বিস্ময় মানতে হয়৷ কিন্তু নীতিবাগীশ বঙ্কিম, সেই জীবনের সফল পরিণতিতে বার বার বাধা দিয়েছেন৷
আসলে উপন্যাস পড়ে মনে হয়, বিদ্যাসাগরের প্রাথমিকে লেখা মাধবের ফাঁসিতে যাওয়া গল্পের মতোই, এগুলির ফল হয় বিষময়৷ সেই জন্যেই বোধ হয় বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের নাম হয় ‘বিষবৃক্ষ’৷ তবে মজার ব্যাপার হল, মরালিস্ট বঙ্কিমের অভিপ্রায় যা-ই থাকুক শিল্পী বঙ্কিমের জাদুস্পর্শে চরিত্রগুলি সজীব, জীবন্ত ও এমন হৃদয়স্পর্শী হয়েছে যে, সেই সময় রবীন্দ্রনাথের বাড়ির মতো বাংলার ঘরে ঘরে তার আবির্ভাবে পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস পড়ার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যেত৷সনাতনপন্থী বঙ্কিমের কাছে শিল্পী বঙ্কিম পরাজয় স্বীকার করে বলেই বারবার বঙ্কিমের হাতে বিধবা নায়িকাদের ‘সতীদাহের’ পরিণতি হয়৷ নির্মল শুভ্র কুন্দফুলের মতো যে কুন্দনন্দিনিকে বঙ্কিম সৃষ্টি করেছেন, বিষবৃক্ষের বিষফলে হয় তার মৃত্যু৷ ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসের সুন্দরী প্রাণবন্ত রোহিণীকে অকারণে অপবাদে হত্যা করা হয়৷ শরৎচন্দ্র একবার প্রশ্ন তুলেছিলেন, রোহিণীকে কেন হত্যা করা হইল?আসলে নীতিবাগীশ বঙ্কিমের কাছে ‘রুক্মিণীকুমার প্রাসাদের ফুলওয়ালি রাধারানীই আদর্শ৷’
নতুবা সামান্য গৃহবধূ প্রফুল্ল থেকে অসীম গুণান্বিতা দেবী চৌধুরাণীতে উত্তরণে যে নারীমহিমার উৎকর্ষ বঙ্কিম জীবন্ত করে তোলেন, তাকে শেষ পর্যন্ত গৃহগত সেবিকায় পরিণত করে, তার চরিত্রকে ব্যর্থ বিফলতায় হত্যা করতে বঙ্কিম দ্বিধাবোধ করেননি৷ এহেন বঙ্কিম, যে স্ত্রীশিক্ষার পক্ষপাতী, বিধবা বিবাহের সমর্থক ও বহুবিবাহ বিরোধী বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে তাঁর কৈশোর-লালিত বিরূপতাকে অজ্ঞানে বিদ্বেষে পরিণত করবেন, তা বলাই বাহুল্য৷
তাছাড়া বিধবাবিবাহ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বঙ্কিমের জীবনাচারেও পার্থক্য খুব স্পষ্ট৷ বিদ্যাসাগর শুধু অপরের ছেলেদের সঙ্গে বিধবাবিবাহ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, নিজের ছেলেরও বিধবার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন৷ কিন্তু নিজেদের পরিবারে বঙ্কিমের আচরণ ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত৷বঙ্কিমচন্দ্রের দৌহিত্রের সঙ্গে স্যার আশুতোষের নাবালিকা কন্যা কমলার বিয়ে হয় এবং অচিরেই কমলা বিধবা হন৷ স্যার আশুতোষ যখন তাঁর বিধবা কন্যার পুনর্বিবাহের চেষ্টা করেন, তখন বঙ্কিমের পরিবার থেকে বাধা আসে, এমনকী তা আদালত অবধি গড়ায়৷ স্যার আশুতোষ অবশ্য আদালতে জয়ী হয়ে কন্যার পুনর্বিবাহ দেন৷
বঙ্কিম সারাজীবন যে বিদ্যাসাগর বিদ্বেষে সরব ছিলেন, তার মারাত্মক পরিণতি ঘটে যখন তিনি ভবভূতির উত্তর রামচরিত সম্বন্ধে আলোচনায় বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস রচনার প্রতি অকারণ তীব্র কটাক্ষপাত করেন৷ এই মন্তব্যটি সূর্যমুখীর উক্তি অপেক্ষা নির্মম ও মর্মান্তিক হয়ে ওঠে৷ তাছাড়া বঙ্কিম, বহুদর্শনে, ‘বহুবিবাহ’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার-দ্বিতীয় পুস্তক’ আলোচনায় তাঁকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন৷ অধ্যাপক অমিত্রসূদনের লেখা থেকে জানা যায়, বঙ্কিমের সমালোচনা পড়ে বিদ্যাসাগর কিছু ‘বিরক্ত’ হয়েছিলেন৷ কিন্তু সেই বিরক্তির ফল হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের পক্ষে খুবই মারাত্মক৷ কেননা ১৮৭৩ সালে এই সমালোচনার দীর্ঘকাল পরে ১৮৯১ সালে বিদ্যাসাগরের মৃত্যু হয়৷ বস্তুত ওই সমালোচনা প্রকাশের পর দীর্ঘ আঠারো বছর বিদ্যাসাগর একপ্রকার লেখাই ছেড়ে দিয়েছিলেন৷ এই সময়েই বিদ্যাসাগরের জীবনে একের পর এক অঘটনের ধাক্কায় ঘোর দুর্যোগ নেমে আসে৷ ১৮৬৫ সালে মেরি কার্পেন্টারের সঙ্গে স্কুল পরিদর্শন থেকে ফেরার পথে উত্তরপাড়ায় গাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর শরীরে প্রচণ্ড আঘাত লাগে৷ এরপর থেকেই তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে৷ পারিবারিক কারণে, পিতা, মাতা, ভাই, পুত্র, পত্নী, আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায়৷ তবুও তিনি অনমনীয় তেজে নিজের আরদ্ধ কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টায় নিযুক্ত থাকেন৷ সমাজ ও পরিজন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে তিনি শহর থেকে দূরে ‘কারমাটার’ সহজছন্দে সাঁওতালদের সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন৷ এই নিশ্চিন্ত অবসরে তিনি নিজে বই-এর প্রুফ দেখতেন৷ কিন্তু বঙ্কিমের আঘাতে আহত না হয়ে তিনি যদি এই সময় সাহিত্যকর্মে নিজেকে নিয়োজিত করতেন তাহলে নিশ্চয়ই তাঁর প্রতিভার দানে বাংলা সাহিত্য অধিকতর সমৃদ্ধ হতে পারত৷কিন্তু বাংলা সাহিত্যের বোধ হয় সেই সৌভাগ্য ছিল না৷ লেখক শিল্পীরা সাধারণত খুব সংবেদনশীল হন এবং যাঁরা সমাজকল্যাণে বা ভাষানির্মাণে কলম ধরেন তাঁরা বিশেষ নামযশের পরোয়া করেন না৷ তাই তাঁদের পক্ষে কিছু ধরাও যত সহজ, ছাড়াও তত৷ ভাগ্যের পরিহাসে এক মনীষীর অকারণ আঘাতে অন্য মনীষী তাঁর সৃষ্টিশীলতা হারান৷ পরিণত বয়সে অবশ্য মনস্বী বঙ্কিম, তাঁর আকৈশোর লালিত বিদ্যাসাগর বিদ্বেষের অন্যায় ভুল বুঝতে পেরেছিলেন৷ সেই জন্যই শেষ বয়সে তিনি চাঁদসদাগরের মনসাপুজোর মতো বামহস্তের অর্ঘ্যে বলেন, “এই সংস্কৃতানুসারিণী ভাষা প্রথম মহাত্মা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্তের হাতে কিছু সংস্কারপ্রাপ্ত হইল৷… বিশেষত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোরম৷ তাঁর পূর্বে কেহই এরূপ সুমধুর বাংলা গদ্য লিখিতে পারে নাই এবং তাহার পরেও কেহ পারে নাই৷” অবশেষে বঙ্কিম যে মহাত্মা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাংলা ভাষায় অবদান অস্বীকার করতে পারেননি এটাই আমাদের সান্ত্বনা৷